জুলাই ২০, ২০১৫

ধ্বনি পরিবর্তনের রীতি (১)

ধ্বনি পরিবর্তনের রীতি (১)


ধ্বনি পরিবর্তনের কারণে ভাষারও পরিবর্তন হয়। পৃথিবীর সকল ভাষায় এ রকম পরিবর্তন হয়।কারণ হিসেবে বলা যায় – জিহ্ববার জড়তা বা আলসেমি, আসাবধানতা বা অমনোযোগিতা, স্থানীয় স্বরের প্রভাব, অনায়াসে উচ্চারণ প্রবণতা , অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি ইত্যাদি।
ধ্বনি পরিবর্তন শব্দের প্রথমে, মধ্যে বা শেষেও ঘটতে পারে। উচ্চারণ রীতির বদলের ফলে  স্পর্শ ধ্বনি হয়ে যেতে পারে উষ্ম বা ঘর্ষণজাত ধ্বনি, মহাপ্রাণ ধ্বনি হয়ে যেতে পারে অল্পপ্রাণ আর ঘোষ ধ্বনি হয়ে যেতে পারে অঘোষ। কোমলতালুর অবস্থান বদলের ফলে একশ্রেণীর ধ্বনি পরিণত হতে পারে আরেক শ্রেণীর ধ্বনিতে; নাসিক্য ধ্বনি হয়ে যেতে পারে অনুনাসিক ধ্বনি, অনুনাসিক  ধ্বনি হয়ে যেতে পারে নাসিক্য ধ্বনি। উচ্চারণ স্থান বদলের ফলে একশ্রেণীর ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে আরেক শ্রেণীর ধ্বনিতে। অর্থাৎ ঔষ্ঠ্য ধ্বনি হয়ে যেতে পারে দন্তৌষ্ঠ্য, আর দন্ত্যধ্বনি হয়ে যেতে পারে দন্তমূলীয় ধ্বনি।
ধ্বনি পরিবর্তনের একটি প্রবণতা হচ্ছে একই শ্রেণীর ধ্বনির সদলবলে পরিবর্তন। অর্থাৎ যেসব ধ্বনির উচ্চারণ স্থান বা উচ্চারণ পদ্ধতি অভিন্ন, সেগুলো একযোগে একই অভিমুখে পরিবর্তিত হয়।
ভাষাবিজ্ঞানিরা বিভিন্নভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে দেখেছেন ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে কতগুলো প্রক্রিয়ায়। তারা ধ্বনি পরিবর্তনের ওই প্রক্রিয়াগুলো শনাক্ত করেছেন, শ্রেণীবিন্যাস্ত করেছেন এবং নামকরণ করেছেন বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে।যেমন-

আদি স্বরাগম
শব্দের আদি/শুরুতে যুক্তব্যঞ্জন থাকলে তার আগে অনেক সময় একটি স্বরধ্বনি যোগ করা হয়। একে বলা হয় আদি স্বরাগম। যেমন-
স্ত্রী > ইস্ত্রী     = (ই)স্ত্রী   - ই ধ্বনির আগমন
স্পর্ধা > আস্পর্ধা  = (আ) স্পর্ধা – আ  ধ্বনির আগমন  
স্কুল > ইস্কুল   =  (ই)স্কুল   - ই ধ্বনির আগমন           

মধ্য স্বরাগম
উচ্চারণের সময় সংযুক্ত ব্যঞ্জন ধ্বনির মাঝখানে স্বরধ্বনি আসলে তা মধ্য স্বরাগম।মধ্য স্বরাগমকে বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তিও বলা হয়ে থাকে  যেমন-
যত্ন > যতন      = য+ত+(অ)+ন – মাঝে অ ধ্বনির আগমন
রত্ন > রতন      = র+ত+(অ)+ন – মাঝে অ ধ্বনির আগমন

অন্ত্য স্বরাগম
উচ্চারণের সময় সংযুক্ত ব্যঞ্জন ধ্বনির শেষে স্বরধ্বনি আসলে তা অন্ত্য স্বরাগম।
সত্য>সত্যি     = সত্য+(ই) – শেষে ই ধ্বনির আগমন
পোকত> পোক্ত   = পোকত+(ও)- শেষে ও ধ্বনির আগমন
   
সমীভবন
ধ্বনি পরিবর্তন প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় প্রক্রিয়া সমীভবন। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ভাষায়ই সমীভবন ব্যাপকভাবে সক্রিয়। সমীভবনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়।  
ক. প্রগত সমীভবন   খ. পরাগত সমীভবন 
ঘ. অন্যোন্য (পারস্পরিক) সমীভবন

ক. প্রগত সমীভবন  
পূর্ব ধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী ধ্বনির পরিবর্তন হয়।
 যেমন-
গলদা (চিংড়ি)->গল্লা, (আঞ্চলিক) = এখানে এর প্রভাবে দ,ল হয়েছে


খ. পরাগত সমীভবন
পরের ধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী ধ্বনির পরিবর্তন হয়।
কর্ম->কম্ম,         = পরের ধ্বনি ম এর প্রভাবে র, ম হয়েছে।
তৎ+জন্য-> তজ্জন্য,    = পরের ধ্বনি জ এর প্রভাবে ৎ, জ হয়েছ।


ঘ. অন্যোন্য (পারস্পরিক) সমীভবন
পরস্পরের প্রভাবে দুটো ধ্বনিই পরিবর্তিত হয় অর্থাৎ
কুৎসিত>কুচ্ছিত       = ৎ এবং স এর প্রভাবে দুটি ধ্বনি-ই  চ এবং ছ   হয়েছে।    

বিষমীভবন
সমীভবনের বিপরীত প্রক্রিয়া হচ্ছে বিষমীভবন। যখন দুটি অভিন্ন বা একই বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ধ্বনির মধ্যে একটি বদলে যায়, তখন তাকে বলা হয় বিষমীভবন।
যেমন-
আনানস-> আনারস,
এছাড়াও শরীর>শরীল, লাল>নাল ইত্যাদি ।

সমধ্বনি লোপ
যখন কোনো শব্দে একই ধ্বনি একাধিকবার থাকে তখন তার একটির লোপ পাওয়াকে বলা হয় সমধ্বনি লোপ।
যেমন- বাংলায় সমভিব্যাহার > সমিভারে, জীবনানন্দ > জীবানন্দ, সাব্যবস্ত > সাব্যস্ত ইত্যাদি হয়েছে।

ধ্বনি বিপর্যয়
একই শব্দের দুটি ধ্বনি যদি পরস্পর স্থানবদল করে, তবে তাকে বলা হয় ধ্বনি বিপর্যয়।
যেমন-
রিকশা > রিশকা
জানলা > জালনা
লাফ > ফাল ইত্যাদি।

স্বরলোপ
দ্রুত উচ্চারণের জন্য শব্দের আদিতে/মধ্যে/শেষে স্বরধ্বনির লোপ হলে, তাকে স্বরলোপ বলে।
স্বরলোপ তিন প্রকার ।
আদি স্বরলোপ
দ্রুত উচ্চারণের জন্য শব্দের আদিতে স্বরধ্বনির লোপ হলে, যেমন- অতসী > তসী, অলাবু > অলাউ>লাউ, আছিল > ছিল ইত্যাদি ।

মধ্য স্বরলোপ
শব্দের মধ্যবর্তী কোনো স্বরধ্বনির লোপ হলে, যেমন-  
গৃহিণী > গিন্নী
কাঁদনা > কান্না
কলিকাতা > কলকাতা ইত্যাদি হয়।

অন্ত্য স্বরলোপ
শব্দের অন্ত্যে/শেষে কোনো স্বরধ্বনির লোপ হলে, যেমন-
আশা > আশ
আজি > আজ
চারি > চার ইত্যাদি হয়।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন